ভারত কেন ইসরাইলের পক্ষে: এক বিশ্লেষণধর্মী দৃষ্টিপাত

 

ভারত কেন ইসরাইলের পক্ষে: এক বিশ্লেষণধর্মী দৃষ্টিপাত 


ভূমিকা

বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে একাধিক বৈপরীত্য ও জোট পরিবর্তনের চিত্র ফুটে উঠছে। একসময় যে ভারত ছিল ফিলিস্তিনের দৃঢ় সমর্থক, আজ সে-ই ইসরাইলের অন্যতম কাছের বন্ধু। প্রশ্ন ওঠে: ভারত কেন ইসরাইলের পক্ষে?
উত্তরটা একক নয়—এটি কূটনীতি, নিরাপত্তা, অর্থনীতি, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাস্তববাদের এক জটিল সমীকরণ।


১. কূটনৈতিক বিবর্তন: গোপন থেকে প্রকাশ্যে

১৯৫০ সালের দিকেও ভারত ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নেয়। তবে ১৯৯২ সালে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। তারপর থেকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ধাপে ধাপে ঘনিষ্ঠ হতে থাকে।

বিশেষত ২০১৪ সালের পর, নরেন্দ্র মোদির সরকার ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক আরও প্রকাশ্যে ও উষ্ণভাবে রক্ষা করে। মোদি ২০১৭ সালে ইসরাইল সফর করেন—যেটি কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম সফর।


২. প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা সহযোগিতা

ভারতের অন্যতম প্রধান নিরাপত্তা উদ্বেগ হলো:

  • পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ

  • চীনের আগ্রাসন

  • কাশ্মীর অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ

এইসব পরিস্থিতিতে ইসরাইল ভারতকে সরাসরি সহায়তা দেয়:

  • ড্রোন প্রযুক্তি (Heron, Harop)

  • স্পাইক অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইল

  • রাডার ও নজরদারি ব্যবস্থা

  • Counter-insurgency ও গোয়েন্দা প্রশিক্ষণ

ভারতের সেনাবাহিনী ও র স্পেশাল ফোর্সগুলোর অনেক প্রশিক্ষণই ইসরাইলি স্টাইল অনুসরণ করে।


৩. কৃষি ও প্রযুক্তিতে ইসরাইলের অবদান

ভারতের জলবায়ু ও কৃষি সমস্যা সমাধানে ইসরাইল কাজ করছে বেশ গভীরভাবে:

  • ৩০+ কৃষি সহযোগিতা কেন্দ্র (CoE) কাজ করছে ভারতে

  • ড্রিপ ইরিগেশন ও পানি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ইসরাইলের প্রযুক্তি ভারতের কৃষকদের উপকারে আসছে

এই ‘Agri-tech diplomacy’ ভারত-ইসরাইল সম্পর্ককে আরও গভীর করেছে।


৪. চীনা প্রভাব ও ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ

ভারত ইসরাইলকে চীনের বিকল্প হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে একটি প্রতিসংহারক ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনা করে।
ইউএস, ইসরাইল ও ভারত—এই ত্রিদেশীয় সম্পর্ক চীনের বাড়তি প্রভাবের বিরুদ্ধে একধরনের soft alliance গড়ে তুলেছে।


৫. ইসলামপন্থী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যৌথ অবস্থান

ভারত ও ইসরাইল—দুই দেশই ইসলামপন্থী জিহাদি সন্ত্রাসবাদের শিকার।

  • ভারত: কাশ্মীর, মুম্বাই হামলা

  • ইসরাইল: হামাস, হিজবুল্লাহ

এই কারণে দুই দেশের মধ্যে একটি আদর্শগত ঐক্য গড়ে উঠেছে সন্ত্রাস মোকাবিলায়।


৬. মোদির আদর্শ বনাম কংগ্রেসের ঐতিহ্য

ভারতের ডানপন্থী রাজনীতি (বিশেষত বিজেপি) ইসরাইলের ন্যাশনালিজম ও হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বের সাদৃশ্য খুঁজে পায়।
মোদি সরকার ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, নিরাপত্তা ও “নিজস্ব সংস্কৃতি” রক্ষার যুক্তিতে ইসরাইলের আদর্শকে সমর্থন করে।

অন্যদিকে, কংগ্রেস ও বামপন্থী দলগুলো ঐতিহ্যগতভাবে ফিলিস্তিনের পক্ষে ছিল।


৭. মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ভারসাম্য: নীরব কূটনীতি

যদিও ভারত ইসরাইলকে সমর্থন করে, তবুও সৌদি আরব, ইরান বা ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করেনি।
ভারত অনেকটা "কৌশলগত ভারসাম্যনীতি" (Strategic Balancing) অনুসরণ করে, যেখানে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ও শ্রমবাজার রক্ষা করে, আর ইসরাইলের সঙ্গে নিরাপত্তা ও প্রযুক্তি ভাগ করে নেয়।


উপসংহার

ভারত আজ যে ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে, তা আবেগ নয়—একটি বাস্তববাদী, সুপরিকল্পিত ও স্বার্থকেন্দ্রিক কূটনীতি
নিরাপত্তা, প্রযুক্তি, বাণিজ্য ও ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য—এই চার স্তম্ভে দাঁড়িয়ে আছে ভারত-ইসরাইল সম্পর্ক।
এটাই বিশ্ব বাস্তবতা: যেখানে নৈতিকতা নয়, স্বার্থই শেষ কথা।

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url